কোভিড-১৯ এর লক্ষণসমূহের মধ্যে সবচেয়ে আশ্চর্যজনক লক্ষণ হল স্বাদ ও ঘ্রাণশক্তি হারিয়ে ফেলা। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সমস্যাটি কয়েক সপ্তাহের মধ্যে আপনাআপনি ভালো হয়ে যায়। তবে প্রাথমিক গবেষণাসমূহ বলছে আক্রান্ত ব্যক্তিদের প্রায় অর্ধেক তাদের অনুভূতিতে দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তন লক্ষ করতে পারেন।
স্টকহোমের ক্যারোলিনস্কা ইনস্টিটিউটের একদল গবেষক এমন ১০০ জন মানুষের উপর পরীক্ষা চালায়, যারা ২০২০ সালের মার্চে কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হওয়ার পর গন্ধশক্তি হারিয়ে ফেলেন। তাতে দেখা যায় ১৮ মাস পরেও প্রতি ২০ জনের একজন নষ্ট হওয়া স্বাদ-গন্ধ ফিরে পাননি।
পূর্ববর্তী গবেষণাসমূহে দেখা গেছে সংক্রমিত ব্যক্তিরা তাদের প্রাথমিক অসুস্থতা থেকে সুস্থ হওয়ার পর ছয় মাস পর্যন্ত উক্ত সমস্যাটিতে ভুগে থাকেন। তবে নতুন গবেষণা বলছে কিছু ক্ষেত্রে এটি আরও দীর্ঘায়িত হতে পারে।
দ্য মেইল অন সানডে'স জিপি কলামিস্ট ডক্টর এলি ক্যানন পাঠকদেরকে জিজ্ঞেস করেন, তারা কোনো দীর্ঘমেয়াদি জটিলতায় ভুগছে কিনা। স্বাদ ও গন্ধহীনতায় ভোগা রোগীরা জবাবে জানান, তারা এমন সমস্যায় ভুগছেন এবং মরিয়া হয়ে এটির একটি সমাধান খুঁজছেন। বহু বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হয়েও পাননি সন্তোষজনক উত্তর।
কেউ কেউ ন্যাজাল (নাকের) স্প্রে ও নাকে গরম পানির ভাপ নিয়ে নিজেরাই সমস্যাটি সমাধানের চেষ্টা করেছেন। আবার কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন হয়তো কখনোই তাদের বোধশক্তি স্বাভাবিক হবেনা।
দক্ষিণ-পূর্ব লন্ডনের ব্রুমলির বাসিন্দা ক্ল্যারি কার্টার হামফ্রে (৪৬) জানান, ১৬ মাস আগে তাঁর করোনাভাইরাস শনাক্ত হয় এবং এখন পর্যন্ত স্বাদ ও গন্ধের অনুভূতি পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসেনি।
"কোভিড-১০ এ আক্রান্ত হওয়ার কয়েকদিন পর আমার স্বাদ ও গন্ধের অনুভূতি কমতে শুরু করে। সে সময়গুলোতে কোনো কিছুরই স্বাদ বা ঘ্রাণ পেতাম না। কখনো কখনো আমার নাকে ড্রেনের ময়লা ও পচা খাবারের উদ্ভট গন্ধ আসতো। আজকে পর্যন্ত এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাইনি," তিনি যোগ করেন।
ক্ল্যারি আরও বলেন, এটি তাঁর খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন এনেছে। "যে খাবারগুলোতে অস্বস্তিকর গন্ধ নেই বলে আমার মনে হয়, প্রতিদিন সে একই খাবার খাই। এতে আমার ওজন অনেক কমে গেছে।"
ডাক্তার তাকে নানা রকম পরামর্শ দিয়েছেন যেমন গন্ধের প্রশিক্ষণ, কিন্তু কোন কিছুই কাজে আসেনি জানিয়ে তিনি বলেন, "ঘ্রাণশক্তি ফিরে পাওয়া থেকে আমি অনেক দূরে। আশায় থাকি হয়তো ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে। আবার আশঙ্কাও করি সম্ভবত আমার জন্য ডাক্তারদের কিছুই করার নেই।"
এই সমস্যার ভুক্তভোগী ক্ল্যারি একাই নন। তার মত বহু পাঠক জানিয়েছেন তাদের ভোগান্তির কথা ও এ থেকে পরিত্রাণ পেতে তারা কী কী উপায় গ্রহণ করেছেন। তারা বলেছেন কয়েক মাস ধরে গন্ধের প্রশিক্ষণ ও লেবু, গোলাপ ফুল, লবঙ্গ ও ইউকিলিপ্টাস শুঁকেও অবস্থার খুব একটা উন্নতি হয়নি। কেইথ ওয়েবস্টার নামে একজন জানান করোনা আক্রান্ত হওয়ার পর থেকে তার নাকে থেকে থেকে ডিটারজেন্ট এর গন্ধ আসে।
শ্বাসপ্রশ্বাস জনিত ভাইরাস তথা জ্বর, সর্দি ও কাশিতে ভোগা রোগীদের জন্য স্বাদ বা গন্ধ না পাওয়া নতুন কিছু নয়। এই সমস্যার আংশিক কারণ গলা ও নাক ফুলে যাওয়া। তবে মাঝে মাঝে এসব ভাইরাস নাকের ছিদ্রে ছোট ইন্দ্রিয়ের ক্ষতি করতে পারে এবং ভাইরাসটি শরীর থেকে চলে যাওয়ার পরও সংবেদনশীলতা মারাত্মকভাবে কমিয়ে দেয়।
স্নায়ুগুলো সুস্থ হয়ে গেলে এগুলোর কিছু অন্যগুলোর চেয়ে ভিন্ন ভিন্ন গতিতে পূর্ণ শক্তিতে ফিরে আসে। যে কারণে রোগী যা ঘ্রাণ পায়না। গবেষণায় দেখা যায় কিছু রোগীর ক্ষেত্রে এসব স্নায়ু পূর্ণভাবে সুস্থ হতে কয়েক বছর পর্যন্ত লেগে যেতে পারে।
নরউইচ মেডিকেল স্কুলের ঘ্রাণ ও স্বাদ হারানো বিষয়ে বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক কার্ল ফিলপট বলেন কোভিডের কারণে সংবেদনশীলতার তীব্র ক্ষতি সাধিত হয়। মহামারীর পূর্বে রোগীদের মধ্যে পাওয়া আলামতসমূহের সাথে এখনকারগুলো প্রায় অভিন্ন মিল।
তিনি বলেন, "ভাইরাসগুলোই গন্ধহীনতার করার কারণ, এটা জানা কথা। তবে কোভিড সংক্রমণের ব্যাপকতা এই সমস্যাটিকে আরও বেশি নজরে এনেছে। আমার কাছে প্রতি মাসে শত শত নতুন রোগী আসে, যাদের সকলেই গন্ধ ও স্বাদ না পাওয়ার সমস্যায় ভুগছেন।
"তাদের অধিকাংশই টিকা আসার আগেই করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। যার মানে ভ্যাকসিন গন্ধ ও স্বাদ হারানোর সমস্যা হ্রাশে ভূমিকা রাখতে পারে।"
করোনাভাইরাস নিয়ে আরো পড়ুন-
গন্ধহীনতায় ভুগছেন, এমন ১৪০ জন করোনা রোগীর উপর চালানো যুক্তরাষ্ট্রের এক গবেষণা মতে এক টানা দুই মাসে দিনে দুইবার অন্তত চার রকমের ঘ্রাণ শুঁকলে এই সমস্যার উন্নতি ঘটতে পারে। তথাপি বিশেষজ্ঞরা বলছেন তাদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রোগীর ক্ষেত্রে এই থেরাপি খুব একটা কাজে দেয়নি এবং প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে নতুন কোন চিকিৎসার।
এই সমস্যা ভুক্তভোগীদের মধ্যকার সম্পর্ক ও সামাজিক জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। তারা ভুগছে বিষণ্ণতায়। "গন্ধের প্রশিক্ষণ সবার ক্ষেত্রে কার্যকর হয়না। তাই তাদের বিষণ্ণতা দূর করতে আমাদের প্রয়োজন ভিন্ন কিছু করা"
গত এপ্রিলে প্রকাশিত একটি জার্মান গবেষণায় দেখা যায় আট সপ্তাহের জন্য নিয়মিতভাবে ভিটামিন এ নাকের ড্রপ নেওয়ার পর ১৪ শতাংশ রোগীর সুস্থতা ত্বরান্ত্বিত করেছিল। এটা দেখে কিছু চিকিৎসক এটির কার্যকারিতা বুঝার চেষ্টা করছেন।
পাঠকদের অনেকে বলছেন ইতোমধ্যে তারা এই ড্রপও ব্যবহার করেছেন কিন্তু কোনো উন্নতি নেই। অনেকের মতে সুস্থতার প্রক্রিয়াটা আসলে সময় ও ধৈর্যের ব্যাপার।
"গন্ধ ও স্বাদ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে মাঝে মাঝে তিন বছর পর্যন্ত লেগে যেতে পারে - এটির সম্পর্ক ঠান্ডার সাথে। তবে এটি প্রায়শ চিকিৎসা ছাড়াই ভালো হয়ে যায়," বলছেন অধ্যাপক ফিলপট।
অল্প সংখ্যক মানুষের ক্ষেত্রে স্বাদ ও গন্ধহীনতা স্থায়ী হতে পারে। পাঠকদের একজন ৭০ বয়সী ফিল ব্রুক্স জানান আট বছর আগে তাঁর 'মাথায় খুব ঠান্ডা' লাগে। তখন থেকে কোনো কিছুতেই স্বাদ ও গন্ধ পান না।
২০২১ সালের ডিসেম্বরে করোনাভাইরাসের নতুন ধরণ ওমিক্রন আসার পর থেকে যুক্তরাজ্যে স্বাদ ও গন্ধহীনতায় ভোগা ব্রিটিশদের সংখ্যা কমেছে। কিংস কলেজ লন্ডন এর গবেষকদের মতে নতুন ধরণটিতে আক্রান্তদের এক পঞ্চমাংশ উক্ত সমস্যায় ভুগছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে দেশটিতে টিকা দানের উচ্চ হার এই হ্রাশের কারণ। তবে তারা এটাও বলছেন ভাইরাসটির নানা ধরণের মধ্যে ওমিক্রন তুলনামূলকভাবে কম সংক্রামক।
সূত্র: ডেইলি মেইল অনলাইন