বৃন্দা কারাত
মুসলিম মেয়েরা মাথায় স্কার্ফ পরবে, এ নিয়ে বিতর্কের কিছু নেই। অথচ বিজেপি শাসিত কর্ণাটকে ঘটে যাওয়া ঘটনাসমূহকে "হিজাব বিতর্ক" হিসেবে বর্ণনা করা হচ্ছে, যা বিভ্রান্তিকর। এটি মুসলিম মেয়েদের শিক্ষার অধিকারের উপর সরাসরি আঘাত। যে অধিকার তাদেরকে দিয়েছে ভারতের সংবিধান। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনও ২৭ জানুয়ারি ইং তারিখে উদিপি জেলা কর্তৃপক্ষকে এক নোটিশে বলেছে এ ঘটনাসমূহে ভুক্তভোগী ছাত্রীদের মানবাধিকার মারাত্মকভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে।
|
ছবি: এনডিটিভি |
খুবই হতাশাজনক ব্যাপার হল কর্ণাটক হাইকোর্ট রাজ্য সরকারের ৫ ফেব্রুয়ারির সম্পূর্ণ অযৌক্তিক আদেশটির বিরুদ্ধে অন্তর্বতীকালীন স্থগিতাদেশ প্রদান করেনি। এতে করে মাত্র দুই মাস পর দ্বাদশ শ্রেণীর বার্ষিক পরীক্ষায় বসতে যাওয়া হাজার হাজার মুসলিম ছাত্রীর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। আদেশটিতে বলা হয় ছাত্রছাত্রীদেরকে কলেজ উন্নয়ন কমিটি বা প্রাক বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের প্রশাসনিক পরিষদ এর আপীল কমিটি নির্ধারিত পোশাক পরে আসতে হবে। প্রশাসনিক কমিটি ইউনিফর্ম (আনুষ্ঠানিক পোশাক) নির্ধারণ না করে থাকলে "সমতা, অখণ্ডতা ও আইন শৃংখলার প্রতিবন্ধক হয় এমন পোশাক পরা উচিৎ নয়।" এই আদেশ প্রদানে উল্লেখ করা হয়েছে কর্ণাটক শিক্ষা আইন, ১৯৮৩ এর ১৩৩(২) নং ধারার। অথচ এই বিশেষ ধারার ব্যবহার প্রশ্নবিদ্ধ। কারণ "শিক্ষার উন্নয়ন" বিষয়েই কেবল রাজ্য সরকারকে সরাসরি হস্তক্ষেপের অনুমতি দেওয়া হয়েছে ধারাটিতে।
এর পেছনের উদ্দেশ্য কিন্তু যথেষ্ঠ পরিষ্কার। কর্ণাটকে কলেজ উন্নয়ন কমিটির নেতৃত্ব দিচ্ছে সে এলাকার নির্বাচিত এমএলএ। উদিপি জেলার যে কলেজটিতে প্রথম ঘটনাটি ঘটে, সেটির নেতৃত্বে রয়েছে বিজেপি এমএলএ, তার ইশারাতেই ক্যাম্পাসে স্কার্ফ নিষেদ্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। অথচ কলেজটিতে এরকম কোন বিধি নেই। বজরাং দলের উদিপি জেলা সম্পাদক সুরেন্দর কোটেশ্বর হুমকি দিয়েছিলেন, "যদি কলেজ (কর্তৃপক্ষ) হিজাব পরার অনুমতি দেয়, তাহলে তারা হিন্দু ছাত্রছাত্রীদেরকে গেরুয়া পরে ক্যাম্পাসে আসতে বলবে।"
তাঁর এই পরিকল্পনা সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় হয়েছে। প্রথমত, সরকার তার মত লোকদের ও বজরাং দলকে দিয়ে উগ্র যুবক ছেলেদের গেরুয়া পরতে উদবুদ্ধ করে। তারপর কলেজে মার্চ করার অনুমতি দেয়, যেখানে মুসলিম মেয়েদের গেটে আটকে দেওয়া হয়। তাদেরকে যখন অপমান-অপদস্থ করা হয়, পুলিশ তখন দর্শকের ভূমিকায়। এবং আদেশ জারি করে মাথায় স্কার্ফ আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় হুমকি এবং তারপর এটিকে নিষিদ্ধ করে, সে কলেজে এ ধরণের বিধান থাকুক বা না থাকুক। উক্ত জেলার আরেকটি কলেজে মেয়েদেরকে মাথায় স্কার্ফ করার অনুমতি প্রদান করে শর্তসাপেক্ষে অর্থাৎ এটির রঙ কলেজ ড্রেসের মতই হতে হবে। তবুও আজকে (১০ ফেব্রুয়ারি) তাদেরকে কলেজের বাইরে আটকে দেওয়া হয়। এটা কি চরম অন্যায় নয়? মুসলিম মেয়েদের এইভাবে টার্গেট করা সম্প্রদায়ে পাল্টা প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেবে এবং মাথায় স্কার্ফ পরা হয়ে উঠবে প্রতিবাদের প্রতীক। যারা আগে পরতোনা, তারাও এখন পরবে। কর্ণাটকে এমনটাই দেখা যাচ্ছে।
বিষয়টিকে এমনভাবে দেখানো হচ্ছে যেন মেয়েরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ইউনিফর্মের বিরোধিতা করছে। কর্ণাটক শিক্ষা মন্ত্রী বিসি নগেশ বলেন, "সরকার নির্ধারিত ইউনিফর্ম পরার জন্য সব ছাত্রছাত্রীদেরকে আহ্বান জানাচ্ছি। আমি এটাও স্পষ্ট করে বলছি, যারা সরকারের স্কুল ইউনিফর্ম সংক্রান্ত বিধিবিধান অমান্য করবে, তারা তাদের কলেজ ও ক্লাসে প্রবেশ করতে পারবেনা।" মুসলিম মেয়েরা নির্দেশিত ইউনিফর্মই পরছে। অতিরিক্ত হিসেবে স্কার্ফ দিয়ে মাথা ঢেকে নিচ্ছে। তারা ইউনিফর্মের জায়গায় বোরকা পরছেনা। এমনকি মুখও ঢেকে রাখছেনা। যখন শিখ ধর্মের ছেলেরা পাগড়ি পরে, তারা কি সরকারের ইউনিফর্ম সম্পর্কিত আদেশ অমান্য করছেনা? ভারতে কি এমন কোন বিধান আছে, যা শিখদেরকে এটি পরতে নিষেধ করে? কেন এই দ্বৈতনীতি?
হিজাব আইনশৃংখলা রক্ষার ক্ষেত্রে সমস্যা, এটি হাস্যকর বিতর্ক। কর্ণাটকে, এমনকি সমগ্র ভারতে, এটি কখনোই আইন শৃঙ্খলার জন্য সমস্যা ছিলো না। প্রতিবেশী কেরালায় মুসলিম মেয়েরা চাইলে মাথায় স্কার্ফ পরতে পারে। নেই কোন জোর জবরদস্তি। এবং এটির কারণে সেখানে আইন শৃংখলা পরিস্থিতি অবনতি হওয়ার কথাও জানা যায়নি। অথচ মুসলিম মেয়েদের মধ্যে শিক্ষার হার এই রাজ্যটিতেই সবচেয়ে বেশি। কর্ণাটক সরকারের নির্দেশনাটিতে জনশৃঙ্খলার উল্লেখ সুপরিকল্পিত। সংবিধানের ২৫ নং ধারায় বলা আছে, "(১) শৃঙ্খলা, নৈতিকতা ও স্বাস্থ্য এবং এই অংশের অন্যান্য বিধান সাপেক্ষে ন্যায় ও ধর্ম স্বাধীনভাবে প্রকাশ, চর্চা ও প্রচার করার সমান অধিকার সবার রয়েছে।"
আমনাহ বিনতে বশীর বনাম কেন্দ্রীয় মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড বা সিবিএসই/২০১৬ মামলায় কেরালা হাইকোর্ট মত দেয় মুসলিম নারীদের জন্য মাথায় স্কার্ফ ও হাতে লম্বা আস্তিন পরা "অত্যাবশ্যক ধর্মীয় অনুশীলন"। মামলাটিতে সিবিএসই ড্রেস কোড তথা খাটো আস্তিন ও মাথা খোলা না রাখার অভিযোগে একজন মুসলিম ছাত্রীকে অভিযুক্ত করা হয়। আদালত ঐ ছাত্রীর আপত্তি বহাল রাখে। কেননা সিবিএসই এর নির্দেশটি জনশৃংখলা নয়, বরং নকল ঠেকানো সম্পর্কিত ছিল। তবে বিচারক মেয়েটিকে নির্দেশ দেয় সিবিএসই নিয়োজিত কর্তৃপক্ষ তাকে চেক করতে চাইলে সে যেন তাদের সহযোহিতা করে। এভাবেই পরীক্ষা প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিশ্চিত ও তার মৌলিক অধিকার সুরক্ষিত করা হয়েছিল। এর আগে ২০১৫ সালে আরেকটি মামলায় (নাদিয়া রহিম বনাম সিবিএসই), হাইকোর্ট মত দেয় দুইজন মুসলিম ছাত্রীর মাথায় স্কার্ফ ও হাতে লম্বা আস্তিন পরিধান করতে চাওয়া তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের অংশ। বহু ধর্ম ও প্রথার দেশে এমন কোনো ড্রেস কোড চাপিয়ে দেওয়া যেতে পারেনা, যা একজন শিক্ষার্থীকে পরীক্ষায় বসা থেকে বিরত রাখে। কর্ণাটক সরকার আদালতের এসব মতকে পাশ কাটিয়ে গেছে এবং পরিকল্পিতভাবে জনশৃংখলা সমস্যা তৈরি করছে।
দেখে খুব খারাপ লাগছে তরুণ ছেলেমেয়েদের আবেগকে নিষ্ঠুরভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। দাঁড় করানো হচ্ছে পরস্পরের মুখোমুখি এবং তৈরি করা হচ্ছে বিভেদ। যে খেলাটি চলছে, তা সুস্পষ্টভাবে হিন্দুত্ববাদি এজেন্ডার প্রসার, যা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়েছে। করোনা মহামারীর জায়গা নিয়েছে সাম্প্রদায়িক মহামারী। ভাইরাসটি তৈরি করা হয়েছে হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীসমূহের ল্যাব থেকে, যা ধ্বংস করছে তরুণদের জীবন।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি'র মতামত বিভাগে ইংরেজিতে প্রকাশিত লেখাটি দ্য ট্রিবিউন এর পাঠকদের জন্য ভাবানুবাদ করা হয়েছে।